23 Nov 2024, 01:45 pm

হাজার মরদেহ গোসল করিয়েছেন রংপুরের ১১২ বছর বয়সী আব্দুর রশিদ

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ

অনলাইন সীমান্তবাণী ডেস্ক : মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের মৃত্যুর পর দাফন-কাফনের আগে মরদেহ গোসল করানো হয়। এটিকে পবিত্র দায়িত্ব মনে করেন মুসলমানরা। কারণ, শেষ গোসলের মধ্যদিয়ে মৃত ব্যক্তির শরীর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও সুন্দর হয়। রংপুরে এমন মৃত নারী-পুরুষ ও শিশুর গোসল সম্পন্ন করার কাজটি করছেন অনেকেই। তাদের একজন আব্দুর রশিদ। যার বয়স ১১২ বছর পেরিয়েছে।

প্রবীণ এই ব্যক্তি এক হাজারের বেশি পুরুষ ও ছেলেশিশুর মরদেহ গোসল করিয়েছেন। তার চোখের সামনে এখনও অত্মীয়-অনাত্মীয় অসংখ্য মানুষের মুখ ভেসে উঠে। মৃত্যু তো সব সময় স্বাভাবিক হয় না, তাই গোসল করানোর সময় সব মরদেহ একই রকম হয় না। কিন্তু আব্দুর রশিদের কাছে মরদেহের গোসল মানে মৃত ব্যক্তির বিদায়বেলায় সর্বোচ্চ সম্মানের কাজটি করা।

প্রথম মরদেহ গোসল দেওয়ার অভিজ্ঞতার কথা জানতে চাইলে আব্দুর রশিদ বলেন, ‌মৃত ব্যক্তিকে কীভাবে গোসল দিয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতে হয় তা আমি আব্দুল জব্বার নামের একজনের কাছে শিখেছিলাম। কিন্তু যখন আব্দুর জব্বার মারা গেলেন তখন আর গ্রামে কেউ গোসল দেওয়ার মতো ছিল না। এ কারণে জব্বারের ছেলেরা আমাকে নিয়ে যান। ওটাই ছিল মৃত ব্যক্তিকে আমার প্রথম গোসল দেওয়া। ওই কাজে আমাকে আব্দুস ছাত্তার ও তাহের সহযোগিতা করেন।

তিনি আরও বলেন, আমি জব্বারের সঙ্গে থেকে অনেকের গোসল দেওয়া দেখেছি। পরে আমার ভাগিনা, ভাগিনার নাতিসহ অনেককে গোসল দিয়েছে। কখনও কারও কাছ থেকে এজন্য টাকা দাবি করিনি। এভাবে পীরগাছা, মাহিগঞ্জসহ আশপাশের বিভিন্ন গ্রামে ছোট-বড় বিভিন্ন বয়সী অন্তত এক হাজার মৃত ব্যক্তির মরদেহ গোসল দিয়েছি। অনেকে দূর-দূরান্ত থেকে আমাকে ডাকতে আসতেন। আমি কাউকে ফিরিয়ে দেইনি। গ্রামের অনেক ছেলেদের আমি এই সম্মানের কাজটা শিখিয়েছি।

আব্দুর রশিদ বলেন, বিনাপারিশ্রমিকে সব সময় মৃত মানুষের গোসল দেওয়ার চেষ্টা করেছি। কখনও কেউ টাকা দিলে নিতাম না। তারপরও অনেকে জোড় করে ১০০-২০০ টাকা করে দিতো। আমি অনেককে এই কাজটা শিখিয়েছি কিন্তু ছেলেদের শেখাতে পারিনি। এখন শারীরিক কারণে কোথাও যেতে পারি না। আমার কোনো শত্রু নেই। গ্রামের সবাই আমাকে ভালোবাসে, সম্মান করে। এখন আমি সারাক্ষণ বাড়িতেই শুয়ে বসে থাকি। ছেলে-মেয়েসহ পরিবারের সবাই আমার দেখাশুনা করে। এখন ছেলেদের হাত ধরে নয়তো কখনও নাতিদের হাত ধরে নামাজ পড়তে মসজিদে যাই। আল্লাহর রহমতে চোখের সমস্যা ছাড়া আমার আর কোনো সমস্যা নেই।

ব্যতিক্রম দু-একটা ঘটনাও ঘটে, যা দীর্ঘস্থায়ীভাবে থেকে যায় গোসলদানকারীদের স্মৃতিতে। তেমন কোনো ঘটনা আছে কি না, জানতে চাইলে আব্দুর রশিদ বলেন, একজনকে গোসল দেওয়ার সময় তার মুখের দিকে তাকিয়ে ভয় পেয়েছিলাম। মুখটা বিকৃত হয়েছিল। দেখতে ভয়ঙ্কর লাগছিল। আমার মনে হয়েছিল ওই ব্যক্তি সম্ভবত নামাজ পড়তেন না। মানুষকে খুব অত্যাচার করতেন। এ কারণে মৃত্যুর পর তার মুখটা ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছিল।

জীবিত থাকা অবস্থায় তাকে মৃত দেখিয়ে সমাজসেবা থেকে দেওয়া বয়স্ক ভাতার ৯ হাজার টাকা একটি প্রতারক চত্রু হাতিয়ে নেন বলেও তিনি অভিযোগ করেন। ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে তার ভাতার টাকা আত্নসাৎ করার বিষয়টি জানাজানি হবার পর নড়ে চড়ে বসে সমাজসেবা। এখন তিনি নিয়মিত বয়স্ক ভাতার টাকা পাচ্ছেন বলেও জানান। ছেলে-মেয়ে এবং ছেলের বউয়েরা এখন তার দেখাশুনা করেন।

বয়স্ক ভাতার কার্ডে আব্দুর রশিদের জন্ম সাল ১৯১১ সালের মার্চ মাস লেখা থাকলেও বাংলা ১২৮৩ বঙ্গাব্দের বৈশাখে তার জন্ম বলে দাবি করেন। তার জন্মস্থান লক্ষ্মীপুর জেলায়। বাবা করিম বকস, মা রাবেয়া বেগম। আব্দুর রশিদেরা ছিলেন ছয় ভাই ও আট বোন। বর্তমানে তিনিসহ আর তার একবোন রংপুরে বসবাস করছেন। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৫ সালে পরিবারসহ রংপুরের পীরগাছা উপজেলার পারুল ইউনিয়নের গুঞ্জরখাঁ উচাটারি গ্রামে এসে বসতবাড়ি গড়ে তুলেছেন তিনি।

আব্দুর রশিদের দশ ছেলে-মেয়ের মধ্যে বর্তমানে ছয় ছেলে ও দুই মেয়ে বেঁচে আছেন। তার এক ছেলে ও এক মেয়ে মারা গেছেন। বছর তিনেক আগে সহধর্মিণী আমিরুন্নেছাকেও হারিয়েছেন তিনি। এখন ছেলেরাই তার দেখাশুনা করেন। আব্দুর রশিদের মতো তার ছেলেরাও কৃষিনির্ভর জীবন জীবিকায় সংসারের হাল ধরেছেন।

তার বড় ছেলে তাজুল হক বলেন, আমরা ছোট থেকে দেখেছি বাবাকে সবাই ডেকে নিয়ে মৃত ব্যক্তির গোসল দিয়ে নিতেন। গ্রামের মানুষেরা তাকে ভরসা মনে করেন। আমরা কখনও এই কাজে তাকে বাধা দেইনি। এটা তো সওয়াবের কাজ। আমার বাবা যা করেছে, তা এক ধরনের মানুষের সেবা করা। আল্লাহর রহমতে গ্রামের সবার সঙ্গে আমার বাবার সম্পর্কটাও অনেক ভালো।

তার নাতি শহিদুল হক বলেন, আমার দাদাকে মানুষ খুব সম্মান করে। এটা দেখে আমাদের খুব ভালো লাগে। এখনও কেউ মারা গেলে গ্রামের লোকজন আগে দাদাকে ডেকে নেন। তার সঙ্গে পরামর্শ করে। কেউ এসে দাদাকে সাইকেলে করে নিয়ে যায়। অনেকে দাদাকে ভালো ভালো খাবার দিয়ে সহযোগিতাও করে।

আব্দুর রশিদের আরেক ছেলে নুরুল হক। তিনি এখন কৃষিকাজ করেন। আগে বাবার অভাবের সংসারের হাল ধরতে রিকশা চালাতেন। সেই অভাবের দিনের কথা বলতে গিয়ে নুরুল হক বলেন, আমার বাবা অসংখ্য মানুষের মরদেহ গোসল দিয়েছেন। আমরা ভাইয়েরা এই ভালো কাজটি শেখার সুযোগ পাইনি। অভাবের কারণে আমাদেরকে বাইরে থাকতে হতো। রংপুরের বাইরে গিয়ে রিকশা চালাতাম। এখন আল্লাহর রহমতে আমাদের অবস্থা একটু ভালো হয়েছে। আমরা যখন নোয়াখালী (লক্ষ্মীপুর জেলা) থেকে রংপুরে এসেছি তখন আমাদের খুব অভাব ছিল।

স্থানীয় বাসিন্দা ও সংবাদকর্মী সৈয়দ বোরহান কবির বিপ্লব বলেন, আমার জানা মতে শুধু আমাদের গ্রামেই নয় পুরো জেলার সবচেয়ে বয়োজৈষ্ঠ্য ব্যক্তি হবেন আব্দুর রশিদ। তাকে দেখার জন্য বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষজন আসে। এখনও গ্রামে কেউ মারা গেলে অনেকেই তাকে ডেকে নেন। আমি আমার বাপ-দাদাদের কাছে শুনেছি, আগে এই গ্রামে কেউ মারা গেলে গোসল দেওয়ার মতো লোক ছিল না। এ কারণে তাকে সবাই ডাকতেন। আমরা গর্ববোধ করি তার মতো মানুষ এখনও বেঁচে আছে।

গ্রামের বাইতুল ফালাহ গুঞ্জরখাঁ উচাটারি জামে মসজিদের মুয়াজ্জিন নূরুল ইসলাম বলেন, মানুষ মারা যাবার পর তার দাফনকার্য সম্পন্ন করার আগে মরদেহ গোসল দিতে হয়। আমাদের গ্রামের সবচেয়ে বয়স্ক ব্যক্তি প্রবীণ আব্দুর রশিদ বহুবছর ধরে সেই কাজটি করে আসছেন। এখন তিনি বয়সের কারণে চোখের দৃষ্টি শক্তি হারিয়েছেন। কিন্তু তার স্মরণ শক্তি ভালো, তিনি এখনও গ্রামের লোকজনকে এই মহতি কাজটি করতে উদ্বুদ্ধ করেন। মৃত ব্যক্তিকে গোসল দেওয়া ভালো এবং সওয়াবের কাজ।

তিনি বলেন, বয়স হলেও তিনি (আব্দুর রশিদ) নিয়মিত মসজিদে এসে জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায় করে। রমজান মাসে তারাবির নামাজ দাঁড়িয়ে পড়েছেন। ওয়াক্তি নামাজগুলো তিনি দাঁড়িয়ে পড়েন। বৃদ্ধ বয়সে তার এমন মনোবল দেখে গ্রামের তরুণ যুবকরা উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত হোন।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

  • Visits Today: 9330
  • Total Visits: 1277774
  • Total Visitors: 4
  • Total Countries: 1668

আজকের বাংলা তারিখ

  • আজ শনিবার, ২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং
  • ৯ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ (হেমন্তকাল)
  • ২০শে জমাদিউল-আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরী
  • এখন সময়, দুপুর ১:৪৫

Archives

MonTueWedThuFriSatSun
    123
252627282930 
       
15161718192021
293031    
       
  12345
2728     
       
     12
3456789
10111213141516
17181920212223
31      
  12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
27282930   
       

https://youtu.be/dhqhRb9y018